চৌদ্দ বছর আগের কথা। থিম্পু শহরের জনাকীর্ণ এক পার্ক। ঘরোয়া আয়োজনে বনভোজন। রাজ কর্মকর্তা ছাড়াও আছেন নগরীর গণ্যমান্য কিছু অতিথি। জিগমে সিংগে ওয়াংচুক তখন রাজা। রাজপরিবারও আমন্ত্রিত। বনভোজন মানেই হইচই, হাসি আনন্দ। কোন বাধা নেই। তরুণ রাজপুত্র খেসারও আছেন অতিথি তালিকায়। রাজার চার স্ত্রীর তৃতীয়জনের পুত্র এই খেসার। পরিবারের বড় ছেলে। আগের ঐতিহ্য মানলে তিনিই রাজপাটে বসবেন। ক্রাউন প্রিন্স হবেন। হবেন ড্রাগন কিং। সবই ভাবনা। বাস্তবতা এখনও অনেক দূরে। খেসার মনের আনন্দে ছুটছেন। অতিথিদের সঙ্গে কথা বলছেন। খেলাচ্ছলে দেখা টুকটুকে এক কন্যার সঙ্গে। রাজপুত্রের বয়স ১৭। আর ফুটফুটে সেই কন্যার সাত। রাজপুত্র মুগ্ধ নয়নে তার দিকে তাকিয়ে। পাড়া বেড়ানো সেই মেয়ের তাতে খেয়াল নেই। কিন্তু রাজপুত্রের? চোখ যেন সরে না। ভবিষ্যৎ ড্রাগন কিং-এর তো একজন ড্রাগন কুইন চাই। ভিড় ছাপিয়ে রাজপুত্র এগিয়ে গেলেন। সরাসরি দিলেন রাজবধূ হওয়ার প্রস্তাব। তুমি যখন বড় হবে আমরা দু’জন তখনও যদি একাকী নিঃসঙ্গ থাকি-তুমি রাজি থাকলে তখন আমার জীবনসঙ্গী হতে পারো। মুচকি হাসলেন পেমা। সেই থেকে অপেক্ষা। দীর্ঘ ১৪ বছর। এর মধ্যে রাজা হলেন খেসার। কিন্তু পেমাকে ভুলতে পারেননি। খোঁজ নিলেন। পেয়েও গেলেন। পেমাও একা। আর যায় কোথায়? বিয়ের প্রস্তাব। শেষমেশ এক হলো দু হাত।

ভুটানের বর্তমান রাজা ও রানী


১৪ বছর আগে ভাবী রাজবধূ হওয়ার প্রস্তাব পাওয়া ড্রাগন কুইন পেমা আজ ভুটানের রানী। পুরোনাম জেতসান পেমা। বর্তমান রাজা জিগমে খেসারের পিতা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক বিশ্ব দরবারে নতুন তত্ত্ব ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনায় ছিলেন। বনভোজনে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে অতিথি তালিকায় থাকা পাইলট কন্যা পেমা কি সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন সত্যিই রাজরানী হতে যাচ্ছেন। তারপরের প্রেক্ষাপট তো জানাই। দুনিয়া অবাক হয়ে দেখলো। ২০১১ সালের ২০শে মে রাজা নিজেই পার্লামেন্টে পেমাকে রানী নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন। শুরু করলেন আনুষ্ঠানিকতা। এ যেন রূপকথার মতোই। কোন সুয়োরানী বা দুয়োরানী তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। রাজা-রানীর বয়সের ব্যবধান ছিল দশ। রাজকীয় এই বিয়ে সম্পন্ন হয় ২০১১ সালের ১৩ই অক্টোবর। তিনদিন ব্যাপী এই আয়োজনে মেতে ছিল পুরো ভুটান। নানা উৎসবপর্বে টানা ছুটি ছিল। ভুটানের মূল শহর ও সড়কগুলো সেজেছিল আলোকসজ্জায়। সে-ও আরেক রূপকথার গল্প। উইন্টার ক্যাপিটাল সিটি বলে পরিচিত পুনাখায় ছিল মূলপর্ব।



অতিথি ছিল সামান্যই। হাতেগোনা দু’-একজন। বন্ধু ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব পুত্র কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তিন দিনব্যাপী বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাজা-রানী দর্শন দিলেন প্রজাদের। স্বর্ণ খচিত মুকুট শোভিত রানী ও রাজা জাতীয় পোশাক ঘো কিড়া পরে হাজির হন জনসমক্ষে। ঐতিহ্যবাহী নাচ, গান আর মংদের প্রার্থনায় তাদের বরণ করে নেয়া হয়। রাজা হতাশ করেননি উপস্থিতদের। থিম্পুর চ্যাংমিলিথান স্টেডিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দশ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে রানীকে চুম্বন করলেন। একবার নয়, দুই বার নয়- পরপর তিনবার। সবার উদ্দেশে রাজার জিজ্ঞাসা আপনারা কি দেখতে চান আমি আপনাদের রানীকে নিয়ে কতটা সুখি, কতটা ভালবাসি- এই বলেই গালে চুম্বন আঁকলেন। স্টেডিয়াম শুদ্ধ ১০ হাজার মানুষ হ্যাপিনেস অব দ্য কিংডমের রাজকীয় চুম্বনের সাক্ষী হয়ে থাকল। তাবৎ মিডিয়ার কল্যাণে চুম্বন পৌঁছে গেল দুনিয়াজোড়া।

এ বিয়ের ঠিক তিন মাস আগেই বৃটিশ রাজপুত্র উইলিয়াম ও কেটের রাজকীয় চুম্বন দুনিয়া মাতিয়েছিল। পুরো রাজধানীই যেন রাজকীয় ভোজে শরিক হলো। ট্রাডিশনাল দাচি আর এগ ফ্রাইড রাইস এই ছিল খাবার মেন্যু। ড্রাগন কিং আর ড্রাগন কুইন হানিমুনে গেলেন রাজস্থানে। বিশেষ হানিমুন ট্রেনের ব্যবস্থা করেছিল ভারত সরকার। শুধু থিম্পু শহরে নয়, পারো বিমানবন্দরে নামার পর থেকেই রাজা-রানীর নানা গল্প মানুষের মুখে মুখে। সব জায়গায় তাদের যুগল ছবি। কি বিমানবন্দর, সরকারি দপ্তর কি জাদুঘর। বৌদ্ধ মঠগুলোতেও তাই। রাজধানী থিম্পুর বড় বড় শপিংমলেও তাদেরই পোস্টার। রানী জেতসান পেমার নামে অনেক দোকান আর স্যুভেনির আছে। তাদের গল্প গাথা সব যেন রাজা-রানীকে ঘিরেই। রাজবাড়ীর সামনে দর্শনার্থীরা উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়ান। কোথায় রাজা-রানী বাস করেন। এ নিয়েও নানা কৌতুহল। এই বুঝি রাজা-রানী বের হবেন নগর পরিভ্রমণে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায়ই উভয়ে বের হন নানা অনুষ্ঠানে। কথা বলেন সাধারণদের সঙ্গে।



রাজা-রাণী প্রায়ই বের হন নানা অনুষ্ঠানে। কথা বলেন সাধারণদের সঙ্গে

ড্রাগন কুইন আর ড্রাগন কিং-এর বেড়ে ওঠা নিয়েও রয়েছে নানা কৌত‚হল। রাজপরিবারের সরাসরি সম্পৃক্ততা না থাকলেও পেমা এক সাধারণ ঘরের মেয়ে হয়েও হলেন রানী। সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে পরিচিত বুমতাং-এর মেয়ে। ১৯৯০ সালের ৪ঠা জুন থিম্পুতেই জন্ম। পিতা ছিলেন ড্রুক এয়ারের পাইলট। পড়াশোনা শুরু লিটল ড্রাগন স্কুল থিম্পুতে। পরে সেন্ট জোসেফ স্কুল কালিম্পং-এ। সবশেষে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনশিপে লন্ডন রিজেন্ট কলেজে পড়াশোনা করছেন। পাঠ না চুকাতেই বিয়ে। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার পঞ্চম রাজা সিগমে খেসার নামগে ওয়াংচুকেরও। ১৯৮০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি জন্ম। আর ৩১ বছর বয়সে বিয়ে ও রাজা হিসেবে অভিষেক। থিম্পুতেই উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেছেন। পরে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভারতের আন্দামান, আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ও লন্ডনের অক্সফোর্ড-এ গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেন। আধুনিক ভুটানকে সুখী ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে রাজা-রানী লড়ে যাচ্ছেন।


ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত.